মো. নাঈম হাসান ঈমন, ঝালকাঠি প্রতিনিধি: জীবনযুদ্ধে একা লড়াই করছেন এক বৃদ্ধ বিধবা নারী। তিনি বসবাস করছেন এক জরাজীর্ণ ভাঙা ঘরে, যা যে কোনো মুহূর্তে ভেঙে পড়তে পারে। মাথার উপর ফাটা টিনের ছাউনি, দেয়ালে জীর্ণ কাঠ ও বাঁশের অবলম্বন—এ যেন দারিদ্র্যের এক বাস্তব চিত্র। কথা গুলো বলছি ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার গালুয়া ইউনিয়নের পুটিয়াখালি গ্রামের মৃত্যু মজিদ হাওলাদারের স্ত্রী ষাটোর্ধ রাজিয়া বেগমের।
দূর থেকে দেখে মনে হয় এটা একটি পরিত্যক্ত ভাঙ্গা ঝুপড়ি ঘর। এখানে কোন মানুষের বসবাস নেই তবে অবিশ্বাস্য হলেও সত্য কয়েকটি বাঁশের সাথে টুকরো টুকরো পলিথিনের কাগজ দিয়ে ঘেরা এই ভাঙ্গা ঝুপড়ি ঘরে ষাটোর্ধ বৃদ্ধ রাজিয়া বেগম স্বামী-সন্তানহীন এক অসহায় জীবন যাপন করছেন। এই অসহায় নারীর জীবন কাটছে অভাব আর কষ্টে।
প্রায় এক যুগ আগে স্বামী মারা যায়, নেই তার কোন সন্তান একাই কাটছেন দিন৷ স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকে তিনি একেবারে নিঃসঙ্গ। স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে তিনি একাই রয়েছেন স্বামীর ভিটায়। বিধবা হয়েছেন এক দশক আগে, অথচ এখনো পাননি বিধবা বা বয়স্ক ভাতা। নেই কোনো স্থায়ী আয়ের উৎস, নেই সরকারি সাহায্য কিংবা সমাজের তেমন সহযোগিতা। অতি কষ্টে দিন যাপন করলেও তার দুর্দশার খবর কেউ রাখেনি। এগিয়ে আসেনি কেউ। অন্তত থাকার ঘরটিই বসবাসের উপযোগী হলে শান্তিতে ঘুম দিতে পারতো খেয়ে না খেয়ে।
স্বামীর নেই তেমন কোন সম্পত্তি আছে শুধু সামান্য এক খণ্ড জমি, তারই উপর দাঁড়িয়ে আছে এক জীর্ণশীর্ণ ঘর, বৃষ্টি থেকে রক্ষা পেতে ঘরের চাল পলিথিন দিয়ে ঢেকে দিয়েছেন। তারপরও বৃষ্টি বা বন্যা এলেই পানিতে ভিজে কাঁদা হয়ে যায়। তখন আর ঘরে থাকতে পারে না আশ্রয় নিতে হয় অন্যের ঘরে, অন্যের করুণার উপর ভরসা করতে হয়। থাকার মতো একটি খাট পর্যন্ত নেই, বাধ্য হয়ে মাটিতে পলিথিন বিছিয়ে শুয়ে রাত কাটান।শীতকালে ছেঁড়া কাপড় জড়িয়ে কোনোমতে ঠান্ডা নিবারণের চেষ্টা করেন। শীতের তীব্রতা আর গ্রীষ্মের প্রখরতা এবং বর্ষায় বৃষ্টিতে ভিজে বাধ্য হয়েই কোন রকম দিনকাটছে। ভাঙা ঘরে যেকোনো সময় সাপ, ব্যাঙ ঢুকে যায়।মানুষের সাহায্যে কোনরকম চলছে তার জীবন। ঘরও উত্তোলন করা তো দূরের কথা। তবু তার একটি স্বপ্ন নিজের একটি ঘর থাকবে। যেখানে ঝড় আসুক, বৃষ্টি নামুক, তবু কাউকে বলতে হবে না, “একটু থাকতে দেবেন?” তার সেই স্বপ্নটুকু কবে পূরণ হবে সেই আশায় দিন কাটছে রাজিয়া বেগমের। আশপাশে সবার ঘরে বিদ্যুৎ থাকলেও এই ঘরে নেই।
সরেজমিনে দেখা যায়, ‘সভ্যতার এ যুগে মানুষ এমন ঘরে থাকাটা বিরল। বলতে গেলে একদম জীর্ণ-শীর্ণ অবস্থায় কয়েকটি বাঁশের সঙ্গে টুকরো টুকরো পলিথিন দিয়ে ঘেরা মরিচাধরা টিনের বেড়ায় থাকছেন তিনি। ঘরের ভিতরে ঢুকলেই দেখা যায় বসবাস করার অনুপযোগী। বৃষ্টি হলেই সব পানি ঘরের মেঝেতেই পড়বে। মানুষের পাড়ায় এ যেন অমানবিক চিত্র। এমন মানবেতর জীবনযাপনের বিষয়ে জানতে চাইলে রাজিয়া বেগম বলেন, ‘দশ বছর আগে আমার স্বামী মারা গেছে। কোন সন্তান নাই, একটি সন্তান হয়েছিলো তাও জন্মের পর জ্বর হলে পরে মারা যায়। একাই রয়েছি স্বামীর ভিটায়। সরকারি কোনো সুযোগ-সুবিধা পাই না। প্রতিবেশীরা কেউ খাবার দেন, কেউ সামান্য টাকা-পয়সা দেন, আবার বৃষ্টির সময় আশ্রয় দেয় এইভাবেই টিকে আছি। স্থানীয়দের সহযোগিতাই তার একমাত্র ভরসা। মানুষের সাহায্যে দুমুঠো ভাত খেতে পারেন, যদি কেউ সাহায্যে না করে তাহলে না খেয়েই থাকতে হয়। থাকার জায়গাটা ছাড়া আর কোন সম্বলও নাই।
তিনি আরও বলেন, একটু বৃষ্টি হলেই তার ঘরে পানি ঢুকে যায়। তখন ঘরে থাকতে পারে না পলিথিন দিয়ে কোন রকম তালাবাসুন ঢেকে অন্যের ঘরে আশ্রয় নিতে হয়। বিধবা ভাতাও পান না। স্থানীয় ইউপি সদস্যের কাছে ভাতার জন্য একাধিক বার যাওয়া হলেও তাকে দেয়নি। শুধু দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে থাকেন। সরকার অনেককে ঘর দিয়েছেন বলে শুনেছেন। একটি বাড়ি পেলে অন্তত মাথা গোঁজার ঠাঁই হতো। সরকারের পক্ষ থেকে অথবা সমাজের বিত্তবানদের সহযোগিতায় যদি থাকার মতো একটি ঘরের ব্যবস্থা হয় তাহলে একটি মাথা গোঁজানোর পরিবেশ হতো।
স্থানীয়দের মতে, তিনি দীর্ঘদিন ধরেই অসহায় অবস্থায় আছেন, কিন্তু সঠিক সহায়তার অভাবে তার জীবন ক্রমশ দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। বর্ষা এলেই ঘর থেকে পানি চুইয়ে পড়ে, শীতকালে ঠান্ডায় কাঁপতে হয়, আর প্রচণ্ড গরমে আশ্রয়হীনতার কষ্ট আরও বেড়ে যায়।
স্থানীয় বাসিন্দা মারুফ বিল্লাহ বলেন, রাজিয়া বেগম পলিথিনে মোড়ানো ঘরেরই মানবেতর জীবন যাপন করছে। বর্ষা কিংবা শীতের মৌসুমে ঘরটিতে বসবাস করার অনুপযোগী হয়ে পড়ে। সামাজিক দায়বদ্ধতার দিক থেকে ঘরটি তৈরি করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। বিত্তবানদের সহযোগিতা পেলেই তাদের থাকার ঘরটিই তৈরি করতে পারবো। তাই সমাজের সচ্ছল ব্যক্তিদের সহযোগিতা কামনা করছি।
রাজিয়া বেগমের প্রতিবেশী মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, এই ভাঙা ঘরে কোন রকম থাকে। বৃষ্টি নামলে পানিতে সব কিছু ভিজে যায় তখন আর ঘরে থাকতে পারে না আমার ঘরে গিয়ে ওঠে। মাঝে মাঝে আমার ঘরে যায় আবার মাঝে মাঝে অন্য কারো ঘরে যায়। আমরা এলাকার মানুষ যে যতটুকু পারি তাকে সাহায্য করি সেটা খেয়ে তার জীবন চলে। চৌকিখাট কিছু নাই পলিথিন বা খেড় বিছিয়ে ঘুমায়। এখন পর্যন্ত তেমন কোন সরকারি সহযোগিতা পায়নি, সরকারি যদি তাকে ঘর তৈরি করে দিতো তাহলে তার একটু আশ্রয় স্থান হতো।
সামাজিক সংগঠন পুটিয়াখালী ভলান্টিয়ার্স এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সৈয়দ শাহাদাত বলেন, রাজিয়া বেগম এক নিঃসঙ্গ ও অসহায় নারী। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে এই পৃথিবীতে তার আপন বলতে কেউ নেই। বসবাস করছেন একটি জরাজীর্ণ ঘরে, যেটি বসবাসের একেবারেই অনুপযোগী। নুন আনতে পান্তা ফুরোয়—ঠিকমতো তিন বেলাও খেতে পারেন না তিনি। শীত, বৃষ্টি বা রোদ—প্রতিটা দিন তার জন্য নতুন এক যুদ্ধ। সরকারি সহায়তায় যদি একটি টিনের ঘরের ব্যবস্থা করা যায়, তবে অন্তত মাথা গোঁজার মতো একটি ঠাই হবে রাজিয়া বেগমের। তার কষ্টের জীবনে ফিরতে পারে সামান্য শান্তি, আর তিনি পেতে পারেন বেঁচে থাকার একটু আশ্রয়।
স্থানীয় ইউপি সদস্য ও গালুয়া ইউনিয়নের প্যানেল চেয়ারম্যান মো. আমিনুল ইসলাম বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, রাজিয়া বেগম বিধবা ভাতার জন্য আমার কাছে কখনো আসে নায় এবং সরকার গত ৪ বছর ধরে বন্ধ করে রাখছে যার জন্য দেওয়া সম্ভব না। ভিজিএফ চাল দেওয়ার মতো তার বয়স নেই তবে তাকে সরকারি ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ১০ কেজি চাল দেওয়া হয়েছে।
এবিষয় রাজাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইউএনও রাহুল চন্দ বলেন, দূর্যোগ ব্যাবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে রাজিয়া বেগমকে তার বসতঘর মেরামতের জন্য টিন দেওয়া হবে। ইতিমধ্যে তাকে ঈদ উপলক্ষে সরকারি ভিজিএফ ১০ কেজি চাল দেওয়া হয়েছে। ভবিষ্যতে তাকে সরকারি সুযোগ সুবিধা দেওয়া হবে।
এমন অবস্থায় স্থানীয় প্রশাসন, মানবিক সংগঠন ও সমাজের বিত্তবানদের প্রতি অনুরোধ, এই অসহায় নারীর পাশে দাঁড়ানোর জন্য। তাকে একটি নিরাপদ ঘর তৈরি করে দেওয়া গেলে, তিনি অন্তত শান্তিতে বসবাস করতে পারবেন। সরকারি ও বেসরকারি সাহায্যের মাধ্যমে তার জীবনে পরিবর্তন আনা সম্ভব। তাই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দ্রুত হস্তক্ষেপ কামনা করছেন স্থানীয়রা, যাতে তিনি নিরাপদ মাথা গোঁজার ঠাঁই পান এবং একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারেন।